বিসিএস ক্যাডার দম্পতির জীবনের গল্প

ছোটবেলায় পড়ালেখার গুরুত্ব খুব একটা বুঝতাম না। বাবা ও মা দুজনই পড়ালেখা জানতো না। মা আমাকে উত্তর সাধনপুর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। পাড়ায় লেখাপড়া জানা কোন মেয়ে কারো বাড়িতে বউ হয়ে আসলে বই খাতা নিয়ে মা আমাকে তার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। বিনিময়ে পতিত জমিতে চাষ করা সবজি, ফলমূল পাঠিয়ে দিতেন। মা পাটি বুনে, মুরগী পালন ও শাক-সবজি চাষ করে আমার বই, খাতা, কলম কিনে দিতেন। প্রতিদিন বাবার সাথে বন থেকে কাঠ নিয়ে আসতাম আমি আর আমার বড় ভাই। কাঠ বিক্রি করেই চলতো আমাদের পরিবার। পরিবারে আমরা দুই ভাই ও তিন বোন। বন থেকে কাঠ নিয়ে আসা ছাড়াও বাবার সাথে মাঠে কাজ করতাম এবং ঘরের কাজে সাহায্য করতাম। ৫ম শ্রেণিতে যখন রোল নম্বর ২ হলো, তখন সবাই আমার পড়ালেখার ব্যাপারে খুব বেশি উৎসাহ দিলেন। কিন্তু পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য আমাদের ছিলনা।’
কথাগুলো বলছিলেন, সম্প্রতি প্রকাশিত ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার ফলফলে প্রশাসন ক্যাডারে ১২৩তম স্থান পাওয়া সাদত হোসেন। বাঁশখালীর সাধনপুর, দুয়ারী পাড়ার মো. আবুল কাশেম ও নুরজাহান বেগমের সন্তান সাদত হোসেন। জন্মের পর থেকেই জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এসেছেন তিনি। প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতেও মনোবল না হারিয়ে স্বপ্ন পূরণের সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।

সাদত হোসেন জানান, এলাকার মরহুম মালেকুজ্জামান সাহেব আমাকে সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে রোল নং ৩ হয়। ৭ম শ্রেণিতে রোল নং ১ নম্বর হলে প্রতিমাসে ১০০ টাকার একটি বৃত্তি পাই। এরপর থেকে প্রতিক্লাশে রোল নম্বর ১ হয় এবং বৃত্তির টাকা পাই। ওই টাকায় চলে আমার পড়ালেখা। শীতকালে গরম কাপড় ছাড়া স্কুলে যাওয়ায় বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হারাধন স্যার নিজের গরম কাপড় খুলে আমার গায়ে জড়িয়ে দেন। মনের মধ্যে আরো শক্তি সঞ্চয় করার সাহস ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই করতে উৎসাহ যোগান তিনি।
২০০৪ সালে পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে আমি ৪.৩১ গ্রেড পেয়ে এসএসসি পাশ করি। এরপর টাকার অভাবে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় শিক্ষকরা আমাকে বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজে ভর্তি করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শহরের নামকরা কলেজে পড়ার জন্য আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে আসি। পকেটে কোন টাকা ছিলনা তাই বাসের ছাদে উঠে চট্টগ্রাম শহরের কালামিয়া বাজার চলে আসি।
এর আগে আমার পরিবারের কেউ কখনো চট্টগ্রাম শহরে আসেনি। তাছাড়া শহরে আমাদের পরিচিত কেউ ছিলনা। কালামিয়া বাজার এলাকার এক দোকানের সামনের ফুটপাতে দুই রাত কাটিয়ে দেই। পরে এক দোকানদারের মাধ্যমে বাঁশখালী এলাকার এক বড় ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। তিনি আমাকে একটি বাসায় লজিং থাকার ব্যবস্থা করে দেন। ওই বাসায় ২ ছেলে-মেয়েকে পড়াতাম, বিনিময়ে থাকা ও খাওয়ার সুযোগ হয়। তখন এলাকায় শিক্ষক হিসেবে আমার পরিচিতি গড়ে উঠে এবং দুটি টিউশনি শুরু করি। এসএসসি পাশ করেই দশম শ্রেণির ছাত্র পাড়াতে শুরু করি। আমার এক ছাত্র আমাকে চট্টগ্রাম সরকারি মহসিন কলেজে নিয়ে যায়। টিউশনে পরবর্তী তিনমাস পড়াব বলে অগ্রীম ১ হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হই।

কলেজ থেকে লজিংয়ের বাসা দূরে হওয়ায় পায়ে হেঁটে যেতে আসতে বহু সময় লেগে যেত। বাসা থেকে ভোর ছয়টায় রওনা হয়েও কলেজে পৌঁছাতে ৯টা পার হয়ে যেত। এভাবে প্রায় সময় কয়েকটি ক্লাশ মিস হয়ে যেতো। ক্লাশ শেষে বাসায় ফিরে টিউশনের জন্য দৌড়াতে হতো। প্রায় সময় দুপুরে খাওয়া হতো না। এভাবে চলতে চলতে একপর্যায়ে শরীর ভেঙে পড়ে। প্রথম বর্ষে ২টি বিষয় খারাপ হয়ে যায়। তাই লজিং ছেড়ে দিয়ে কলেজ হোস্টেলে উঠার চেষ্টা করি। কিন্তু লজিং থাকা ওই পরিবারের কর্তা আমাকে আরো ৩ মাস পর হোস্টেলে যেতে বলেন। জোরাজুরির একপর্যায়ে বইখাতা সবকিছু রেখেই পালিয়ে আসি।
তখন ৩ রাত মহসিন কলেজের পর্তুগিজ হলের সিড়িঁতে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই। সকালে বন্ধু তানভীরের দেওয়া সিঙ্গারাই ছিল আমার সারাদিনের খাবার। তৃতীয় দিন রাতে পর্তুগিজ হলের সিড়িঁতে আমাকে ঘুমাতে দেখে হোস্টেল সুপার ফকরুল মাওলা পথশিশু ভেবে ঘুম থেকে তুলে ধমক দেন। তখন কলেজের ছাত্র হিসেবে আমার পরিচয় জানতে পেরে ৩ মাস আমার খরচ চালানোর দায়িত্ব নেন তিনি। এরই মধ্যে আমাকে টিউশনি জোগাড় করে নিতে বলেন। তার সহযোগিতায় বন্ধু এহসানের সাথে আমি মহসিন কলেজের পর্তুগিজ ভবনে উঠি। কিন্তু এর কিছুদিন পরই পুরাতন পর্তুগিজ ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। তখন ওই হলের সকল ছাত্র অন্যত্র চলে যায়। এরমধ্যে বন্ধুদের সহযোগিতায় আমি কয়েকটি টিউশনি পেয়ে যাই। কিন্তু অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় একা পর্তুগিজ ভবনে থাকতে শুরু করি। ভবনটির নিচ তলায় ৪ ফুট পানি জমে থাকতো। এই পানি মাড়িয়ে প্রতিদিন আমাকে যাওয়া আসা করতে হতো। পর্তুগিজ ভবনটি জনশূন্য হয়ে পড়ায় রাতে শেয়াল ও কুকুর আশ্রয় নিত সেখানে। এক রাতে শিয়ালের ভয়ে কাঁঠাল গাছে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
বিকালে চকবাজার প্যারেড মাঠের সামনে দিয়ে যখন টিউশনিতে যেতাম, তখন আমার বয়সী ছেলেদের মাঠে খেলতে দেখে কষ্ট লাগত। আমারও তাদের মত খেলাধূলা করতে ইচ্ছা করত। কিন্তু টিউশনির চাপে খেলতে পারতাম না। বন্ধুদের মত একটা জিন্সের প্যান্ট পড়ার স্বপ্ন দেখতাম।

২য় বর্ষে দরিদ্র তহবিলে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু আমাকে টাকা দেওয়া হয়নি। যাদের বাবা ব্যাংকে, এনজিওতে চাকরি করতো তারাও দরিদ্র তহবিলের টাকা পেয়েছিল। এ বিষয়ে আমি কলেজের উপাধ্যক্ষ শুক্লা ইফতেখার মেডামকে জানায়। আমি মেডামকে গিয়ে বলি আমাকে একটা টিসি দেন। আমি এখানে আর পড়বো না। তখন মেডাম জানতে চান, তুমি কেনো পড়বেনা? পড়ালেখা না করে তুমি কি করবে? আমি বলি একটা কুরিয়ার সার্ভিসে পরিচিত একজন আমাকে চাকরি করার জন্য বলেছে। আমি সেখানে চাকরি করবো। হোস্টেলে সিটের জন্য আবেদন করেও সিট না পেয়ে গত তিনমাস ধরে আমি কলেজের পরিত্যক্ত নির্জন পর্তুগিজ ভবনে কোমর পানির মধ্যে একা ভয়ে ভয়ে রাত কাটাচ্ছি। আর দরিদ্র তহবিলের টাকা পাচ্ছে ভালো পরিবারের সন্তানরা। এই কথা শুনে শুক্লা মেডাম আমাকে ৫০০ টাকার বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেন এবং হলে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এরপর থেকে শুক্লা মেডাম আমার পড়ালেখার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতেন এবং আমার জন্য ফলমূল পাঠাতেন।
২০০৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষা চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে আমি মেধাতালিকায় ১৭তম হই। তখন মেডাম আমাকে মহসিন কলেজেই ইংলিশে অনার্স করতে বলেন, যেন তিনি আমার দেখাশোনা করতে পারেন। কিন্তু আমি বন্ধুদের সাথে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সি ও ডি ইউনিট থেকে ফরম নেই এবং বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকি। পরে ডি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১৪৭তম হই এবং ওয়ার্ল্ড রিলেজিয়ন কালচার সাবজেক্টে ভর্তি হই। হলে সিট না পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের ছাদে ও টিভি রুমে ৪ মাস কাটিয়ে দেই। এসময় নানাভাবে র‌্যাগিংয়ের শিকার হই। এসময় হলের এক বড় ভাই দিনে ১৪ বার সালাম দেওয়ার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ পালন করলে একমাস পর তিনি আমাকে গণরুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিবে বলে জানায়। কিন্তু ৬ মাস পর গণরুমে থাকার ব্যবস্থা হয়। তাও আবার দুই শিফটে। প্রথমে একদল রাত তিনটা পর্যন্ত ঘুমাবে। পরে আরেক দল রাত তিনটা থেকে সকাল পর্যন্ত ঘুমাবে। জিয়া হলের ১০৯ নম্বর এই গণরুমে ৩০ থেকে ৪৫ জন থাকতো। এই রুমকে ব্যাঙ্গ করে হরিঘোষের গোয়াল বলা হতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও বিবিএ পড়ার স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করি। ২০০৭ সালে আবার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বিবিএ-তে ৩৮৪তম হই এবং ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস সাবজেক্টটি পাই। এরপর বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করি। টিউশনির পাশাপাশি একাডেমিক পড়াশোনা চালিয়ে যাই এবং বিসিএস এর প্রস্তুতি নিতে থাকি। ২০১১ সালে বিবিএ ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ৩৩তম বিসিএস-এ এ্যাপেয়ার্ড হিসেবে আবেদন করি। তখন প্রিলি, রিটেন ও ভাইবা পরীক্ষায় নন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হই। এরপর ৩৪তম বিসিএস-এ প্রিলি ও রিটেন দেই। ৩৫তম বিসিএস-এ নন ক্যাডারে সহকারী পরিচালক (জেনারেল) হিসেবে বিআরটিএ চট্টগ্রামে যোগ দেই। ৩৬তম বিসিএস-এ আবারো নন ক্যাডারে তালিকাভুক্ত হই। ৩৭তম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষাটি খারাপ হয়। সর্বশেষ ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারে ১২৩তম হই।
সাদত হোসেনের স্ত্রী নুর পেয়ারা বেগম নিলু। তিনিও ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারে ১৫তম হয়েছেন। বাঁশখালীর সাধনপুর ৬নং ওয়ার্ড দুয়ারী পাড়া গ্রামের মো. জাকারিয়া ও হামিদা বেগমের সন্তান নুর পেয়ারা বেগম নিলু। তিন বোন ও এক ভাইয়ের সংসার।

নুর পেয়ারা বেগম নিলু জানান, ছোট বেলা থেকেই দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে এসেছি। সংসারের খরচ জোগাতে বড় বোন ফরিদা বেগম ঠিক সময়ে বিয়ে করেতে পারেন নি। টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ ও সংসারের খরচ জোগাতে হয়েছে। স্বামী সাদতের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে একসাথে স্বপ্ন দেখা শুরু করি। জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০১৯ সালের ফেব্রূয়ারিতে বিয়ের পর সংসার শুরু করি। কিন্তু লক্ষ্যের প্রতি আমাদের মনোবল সবসময়ই অটুট ছিলো। কখন রাত, কখন দিন সেটা না ভেবে দুজনেই পড়ালেখা করেছি। গত ১৯ জানুয়ারি আমাদের সন্তান আহনাফ হোসেন আরহাম পৃথিবীতে আসে। আরহাম পেটে থাকা অবস্থায় ৩৮তম বিসিএস এর ভাইবা পরীক্ষায় অংশ নেই। আল্লাহ আমাদের কষ্ট সার্থক করেছেন।
সাদত হোসেন বলেন, জীবনে বাধা আসবেই। তাই বলে মনোবল হারানো যাবেনা। ধর্য্য ধরে সাফল্য লাভের জন্য বারে বারে পরিশ্রম ও সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। যুদ্ধ না করলে যুদ্ধজয়ের স্বাদ পাওয়া যায়না। সফল হতে চাইলে সাধনার কোন বিকল্প নেই।

Leave a Comment